
দূর্জয় দাশ: সকালের শুরুটা এখন আর পাখির ডাক বা সূর্যের আলোয় নয় — শুরু হয় ফোনের আলোয়। স্ক্রিন জ্বলে উঠলেই আমাদের মনে পড়ে যায়, আজকেও একটা দৌড় বাকি আছে। নোটিফিকেশন, মেইল, অ্যাসাইনমেন্ট, টার্গেট — জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন টিকটিক করা ঘড়ির সঙ্গে বাঁধা। আমরা দৌড়াচ্ছি — কেউ চাকরির পেছনে, কেউ ভালোবাসার, কেউ বা স্বীকৃতির। কিন্তু সেই দৌড়ের শেষ কোথায়?আদৌ শেষে সুখ আছে তো?
“দেখাতে জানি, বাঁচতে জানি না”
আমাদের প্রজন্ম জানে কীভাবে হাসতে হয়, কীভাবে ফিল্টার বসাতে হয়, কিন্তু ভুলে গেছে কীভাবে সত্যিকারের অনুভব করতে হয়। ইনস্টাগ্রামের হাসি নিখুঁত, কিন্তু চোখের নিচের ক্লান্তিটুকু সেই ফিল্টারে ঢাকা পড়ে না। সাফল্যের আলো যত উজ্জ্বল হয়, অন্তরের অন্ধকারও তত গভীর হয়।
“পিছিয়ে পড়ার ভয়” – আধুনিক মানসিক রোগ
ভয়টা এখন শুধু পরীক্ষায় ফেল করার নয়, ভয় এখন ইনবক্সে “seen” হয়ে যাওয়ার, ভয় এখন অন্যের সাফল্যে নিজের মূল্য হারানোর। তুলনা যেন এখন আমাদের প্রাত্যহিক অভ্যাস। বন্ধুর পদোন্নতি মানে নিজের ব্যর্থতা, কারও বিদেশে পড়া মানে নিজের হীনমন্যতা। এই তুলনার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে আমাদের আত্মবিশ্বাস, বন্ধুত্ব, এমনকি ভালোবাসাও।
“সবাই ছুটছে, কেউ জানে না কোথায় পৌঁছাতে চায়”
ছোটবেলা থেকে শিখেছি — “প্রথম হতে হবে!” ক্লাসে নাম্বার কম পেলেই বাবা-মা হতাশ, শিক্ষক বিরক্ত, বন্ধুরা ব্যঙ্গ করে। তারপর একদিন দেখি, সেই দৌড়টা শেষ হয় না। স্কুলের পর কলেজ, তারপর চাকরি, ক্যারিয়ার – প্রতিটি ধাপে একই চাপ, একই শব্দ — “আরও ভালো করো!” কিন্তু কিসের ভালো? কার ভালো? কেউ জিজ্ঞেস করে না — আমি কি সুখী?
জীবন কোনো প্রতিযোগিতা নয়? প্রতিযোগিতা খারাপ নয় — কিন্তু সেটা যদি নিজের অস্তিত্ব গিলে ফেলে, তাহলে জয়ও আসলে পরাজয়। জীবনকে যদি এক দৌড় নয়, এক যাত্রা হিসেবে দেখা যায়, তাহলেই হয়তো বদলে যাবে সবকিছু।
হয়তো থামতে হবে, নিঃশ্বাস নিতে হবে, নিজের ভেতরের শান্তিটাকে ছুঁয়ে দেখতে হবে। কারণ সুখ কখনো পাওয়া যায় না অন্যের পেছনে — সুখ লুকিয়ে থাকে নিজের ভেতরেই।
আমরা এমন এক প্রজন্ম, যারা প্রতিদিন নতুনভাবে জেতে, কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে হারে। তবু আশার আলো নিভে যায়নি — যে দিন আমরা দৌড়ের মাঝে এক মুহূর্ত থামতে শিখব, নিজেকে অনুভব করব, সেদিনই হয়তো বুঝব — জীবন আসলে জেতার নয়, বাঁচার নাম। নিজেকে একবার প্রশ্ন করুন দেখি! “আপনি আজ কি এক মুহূর্ত থেমে নিজের ভেতরের শান্তি খুঁজেছেন?”
লেখক: দূর্জয় দাশ
Leave a Reply