মো. মুজিব উল্ল্যাহ্ তুষার: টেকসই কৃষি খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম হাতিয়ার। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় পাহাড়ি কৃষির অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। বৈচিত্র্যময় ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পাহাড়ি কৃষি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কৃষির উন্নয়ন মানে অর্থনীতির উন্নয়ন। বর্তমান সময়ে কৃষিভিত্তিক ব্যবসা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। কৃষক লাভজনক কৃষিকে খুঁজছে। লাভজনক কৃষি বলতে এমন একটি কৃষি ব্যবস্থাকে বুঝায় যা কৃষক সহজলভ্য টেকসই ও পরিবেশবান্ধব প্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার করে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করে তা খুচরা বা পাইকারি বাজারে এমনকি রপ্তানি করে অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারে। কৃষি ব্যবস্থাপনার মূল নিয়ামক হচ্ছে কৃষির সাথে সম্পর্কযুক্ত কৃষি পণ্য উৎপাদন, প্রযুক্তির প্রয়োগ, বণ্টন,প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও ভোগ। আর এসব কিছুর সাথে অর্থনীতির একটা সম্পর্ক রয়েছে। তবে লাভজনক কৃষির প্রধান নিয়ামক সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা। এক সময় মানুষ কৃষি বলতে জমি চাষ করে ফসল উৎপাদনকে বুঝাতো। এখন কৃষি লাভজনক হচ্ছে কি না সেদিকে মানুষের খেয়াল বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল একটি কৃষি বৈচিত্র্যময় এলাকা যা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা নিয়ে গঠিত। কৃষির উন্নয়নের দিক থেকে অত্র অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। ইহা দেশের এক দশমাংশ এলাকাজুড়ে অবস্থিত। যার আয়তন ১৩২৯৫ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা ১.৭ মিলিয়ন (প্রায়) এবং বসতবাড়ির সংখ্যা প্রায় ৩৪২৩৯০টি।
পাহাড়ি অঞ্চলে শস্যের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো বড় চ্যালেঞ্জ। পাহাড়ি কৃষি সমতল কৃষি থেকে ভিন্ন। এখানে ভ্যালি এগ্রিকালচার এবং আপল্যান্ড তথা উচ্চভূমি কৃষিই পার্বত্য অঞ্চলের কৃষিকে প্রতিনিধিত্ব করে। ভ্যালি এগ্রিকালচার সমতল ভূমির কৃষির মতোই। আপল্যান্ড এগ্রিকালচার যেমন জুম চাষ এবং উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল চাষাবাদকে বুঝায়। ভ্যালি এগ্রিকালচারকে লাভজনক করতে হলে বিদ্যমান অলাভজনক শস্যপর্যায়ের পরিবর্তন আনয়ন জরুরি। বিশেষ করে তামাক চাষের পরিবর্তে লাভজনক শস্যপর্যায় প্রবর্তন করা যেতে পারে। তার জন্য তামাকের মতোই বিপণন সুবিধা বাড়াতে হবে। এক ফসলি জমিকে দু’ফসলি এবং দু’ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করার প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে। চার ফসলভিত্তিক শস্যপর্যায় প্রবর্তনের উপর গবেষণা প্রয়োজন। উচ্চমূল্য ফসলের আবাদ ব্যাপক আকারে সম্প্রসারণ করা জরুরি। পাহাড়ি এলাকা উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন সময়ের দাবি। কৃষকদের হাতে-কলমে এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের উপর প্রশিক্ষণ প্রদানসহ ভর্তুকিমূল্যে এসব যন্ত্রপাতি কৃষকদের সরবরাহ করা যেতে পারে। ভ্যালি এগ্রিকালচারে নার্সারি একটি কম পুঁজিতে অধিক লাভজনক ব্যবসা। বছরজুড়ে এ ব্যবসা চালান যায়। এতে ব্যবসা এবং পরিবেশ দুটোই রক্ষা হয়।
উচ্চ ভূমি কৃষিতে জুম চাষের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো অতীব জরুরি। জুমের প্রধান ফসল স্থানীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধান, মারফা, ছোট আকারের জুম মিষ্টিকুমড়া, কাউন, তিলসহ আরও অনেক ফসল রয়েছে। এসব ফসলকে গবেষণার মূল ধারায় নিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর যেতে পারে। যদিও কিছু কিছু ফসলের উপর বারি ইতোমধ্যে গবেষণা করছে। তবে এর ফলাফল দ্রুত কৃষকের মাঝে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। জুমের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে জুমের সার ব্যবস্থাপনা ও বালাই দমনের উপর সমন্বিত পদ্ধতি উদ্ভাবন অপরিহার্য। আপল্যান্ড এগ্রিকালচারে মিশ্র ফলজ বাগান ইতোমধ্যে পাহাড়ি এলাকায় নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। উৎপাদন ব্যবস্থাকে অধিক লাভজনক করতে হলে কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের কোন বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে অর্গানিক ফার্মিংয়ের সুযোগ রয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে এলাকা উপযোগী এবং চাহিদানির্ভর পণ্য উৎপাদন করতে পারলে লাভজনক কৃষিতে রূপান্তর করা সহজতর হবে। যেমন : যেখানে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো সেখানে অপেক্ষাকৃত বেশি পচনশীল কৃষিপণ্য উৎপাদন করা; যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ সেখানে অপেক্ষাকৃত কম পচনশীল কৃষি পণ্য উৎপাদন করা, আর যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ সেখানে অপচনশীল বা মসলাজাতীয় বা ঔষধি গাছের বা বনজ গাছের বাগান করা যেতে পারে।
কৃষি প্রযুক্তি প্রসারের কারণে পাহাড়ি অঞ্চলে দিন দিন কৃষি উৎপাদন বেড়ে চলেছে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনা সনাতনী পদ্ধতিতে চলে আসছে। বেশির ভাগ কৃষক উৎপাদিত পণ্য নিজেরাই বিছিন্নভাবে একাকী বাজারে বিক্রি করে। ফলে দরকষাকষির ক্ষমতা হারায় এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। দুর্গম উৎপাদন স্থল, দুর্বল কৃষক সংগঠন বা সংগঠন না থাকা, বৃহৎ বাজারে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের প্রবেশাধিকার সীমিত, পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে একই পণ্যের উপর বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা প্রদান, পণ্যের দরকষাকষিতে মধ্যস্বত্বভোগী সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা, শস্য সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার জ্ঞানের স্বল্পতা, সংরক্ষণাগারের চরম অভাব, কালেকশন সেন্টার বা প্যাক-হাউজ না থাকা, পণ্যের মূল্য সংযোজন কার্যক্রম সীমিত, চাহিদা মোতাবেক পণ্য সরবরাহ নিরবছিন্ন না হওয়া, মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনে স্বল্পতা এবং কৃষক-ব্যবসায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবাদাতাদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাব লাভজনক কৃষির প্রধান অন্তরায়। কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেলে, সঠিক সময়ে এবং স্বল্পখরচে পণ্য বিক্রি করতে না পারলে কৃষি লাভজনক হবে না। তবে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের ওপর কাজ করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও দেখা যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে উৎপাদনকেন্দ্রিক প্রকল্পের পাশাপাশি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ টেকসই আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার উপর সমন্বিত মেগা প্রকল্প গ্রহণ জরুরি।
পার্বত্য অঞ্চলে এখন অনেক বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠেছে। এদেরকে রপ্তানিমুখী ও টেকসই লাভজনক করতে হলে অত্র অঞ্চলে একটি বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি।
লেখক: মো. মুজিব উল্ল্যাহ্ তুষার, ডিপ্লোমা কৃষিবিদ।
Leave a Reply