বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল: একটি দেশ ও জাতি গঠনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য একটি বিষয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এমন একটি বন্ধন যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থান করে কেউ নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে না, কেউ কাউকে শত্রু হিসেবে গণ্য করে না, একই সমাজ ও রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে সকলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকে তাহলে তারা কখনোই একটি শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতা কখনো কারো কোনো মঙ্গল করতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতা কেবল মাত্র মানুষে মানুষে হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি সৃষ্টি করতে পারে। এটা মানুষকে সংঘাত ও সংঘর্ষে উৎসাহী করে তোলে। মানুষকে করে সহিংসতাপ্রেমী ও যুদ্ধবাজ। সাম্প্রদায়িকতা মানুষকে বর্বর ও পাশবিক করে তোলে। মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করে এই সাম্প্রদায়িকতা। ফলে জাতীয় জীবন স্থবির হয়ে পড়ে। মানুষের সম্পদ ও প্রাণহানী ঘটে। সমাজে অরাজকতা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। জাতীয় অগ্রগতি থমকে যায়।
এদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী যেভাবে পারস্পরিক সহাবস্থান করে, বিশ্বের খুব কম দেশেই এমনটি দেখা যায়। একইসঙ্গে চলা, খাওয়া এবং পারস্পরিক সদাচার ও সদ্ভাবের সঙ্গে তারা এক অপূর্ব সহাবস্থানের মধ্যে বসবাস করে যাচ্ছে হাজার বছর ধরে। মুসলিমদের তাজিয়া বা মহররমের মিছিলে কিংবা ঈদের আনন্দে প্রতিবেশী হিন্দু-বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীকে যেমনটি দেখা যায়, হিন্দুদের দুর্গা পূজা ও খ্রিস্টানদের বড়দিনেও মুসলিমদের স্বপ্রণোদিত উপস্থিতি দেখা যায়। এককথায়, বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠান একক কোনো ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না থেকে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। হাজার বছর ধরে এই বাংলায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রায় সকলেই ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ই এই নীতিতেই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। ৫২, ৬৯, ৭০, ৭১-এ বাঙালি জাতি তাদের অসম্প্রদায়িক চেতনার স্বাক্ষর রেখেছে। তাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর একতাকে চিরভাস্বর করেছে। মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, খাসিয়া, সাঁওতাল নির্বিশেষে সকলে এক হয়ে যুদ্ধ করেছে। আমাদের প্রত্যেকটি উৎসবে বাঙালি জাতি এক হয়ে যায়। পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা, বড়দিন, বৌদ্ধপূর্ণিমা, বৈসাবি আর জাতীয় দিবসগুলোতে সাম্প্রদায়িক পরিচয় ভুলে এক জাতি হিসেবে সকলে সমান অংশগ্রহণ করে।
বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র বানাতে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকল ধর্ম, বর্ণের মানুষের আত্মত্যাগ, মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং এক নদী রক্ত পেরিয়ে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে এনেছি আমরা। ধর্ম-বর্ণের কুৎসিত রাজনীতির কবর রচনা করতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, হয়নি শুধুমাত্র একটি লাল সবুজ পতাকা এবং একটি ভূখন্ডের জন্য। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার জন্য এবং সব ধমের্র মানুষের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। এ উপমহাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ফায়দা আদায় করা স্বার্থান্বেষী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোর দীর্ঘদিনের একটি চর্চিত বিষয়; যা বর্তমান আধুনিক যুগেও তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আসলে যুগে যুগে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো মাথাচাড়া দেয়ার এত সাহস ও শক্তি পেতো না। যদি নিকট অতীতে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত রামু, নাসিরনগর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনাগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট হোতাদের চিহ্নিত করে বিচারের মাধ্যমে যথাযথ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে আজকে এরকম পরিস্থিতি বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটতো না। আসলে আমাদের দেশে পরিস্থিতি হয়েছে এমন, একটি ঘটনা সংঘটিত হবার পর আরেকটি ঘটনা ঘটলে পূর্বের ঘটনা আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। তাছাড়া ঘটনার তদন্ত হলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও সুপারিশ কখনো আলোর মুখ দেখে না। এ দেশে অতীতেও নানান সময় ধর্মীয় ইস্যুকে ঘোলা জলে মাছ শিকারের মতো রাজনীতি করার মোক্ষম হাতিয়ার করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। ততদিন হবে যতদিন পর্যন্ত না মানুষ শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি চিন্তা-চেতনায়ও যৌক্তিক আচরণ করার মতো শুভ বোধ-বুদ্ধির অধিকারী হবে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার ভিত্তিতে আমরা সাম্প্রদায়িক হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানিমুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের দিকে সবাইকে মনোযোগী হতে হবে। এহেন কুরুচিসম্পন্ন ও ঘৃণ্য কাজকে আমাদের প্রতিরোধ করার জন্য সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাই আসুন সুনাগরিক হিসেবে সব গোত্রীয় মানুষ একই ছাতার নিচে সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্কের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে একটি সুন্দর পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করি। আর তাহলেই পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশকে একটি আদর্শ ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করা সম্ভব হবে। কারণ সকল ধর্মই মানুষকে শান্তি ও সম্প্রীতির পথ দেখায়।
প্রাথমিক শিক্ষায় অবস্থা থেকে যদি শিশুরা ‘উদার মানবতার’র শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠে তাহলে পরবর্তী সময়ে তার পথভ্রম হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। আমরাও স্বপ্ন দেখি অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক মুক্তবুদ্ধির চর্চার; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার। আমরা পারব নৈতিকতার শিক্ষা নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। তাহলেই সমাজ ও দেশ থেকে বিতাড়িত হবে ভাইয়ে-ভাইয়ে, পরিবারে-পরিবারে গোত্রে-গোত্রে এমনটিক বর্ণে বর্ণে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি। তাহলেই বাংলাদেশ একদিন বিশ্ব-ভুবনে হয়ে উঠবে উদারতা ও মুক্ত-চেতনাধারী নাগরিকদের প্রতীক। তবে এ কথা বলা যায় যে, আন্তঃগোত্রীয় বিভিন্ন মহলের ইন্ধনে আন্তঃগোত্রীয় মহাজাল বা বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে। সাধারণ বিষয় থেকে শুরু করে অত্যন্ত নোংরা ও ন্যক্কারজনক ঘটনার সংঘটনে কারো কোনো দ্বিধা বা সংকোচ কাজ করছে না। এহেন অপকর্মকে আড়াল করার জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামাজিক প্রভাব, আর্থিক দাপটসহ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব প্রতিপত্তিকে পর্যন্ত কাজে লাগানো হচ্ছে। এরকমভাবে যদি দীর্ঘদিন ধরে অন্যায়-অবিচার চলতে থাকে তবে তা একসময় বিষাক্ত মহীরু হতে পরিণত হয়ে বিস্ফোরণমুখ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
কবির ভাষায় “জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি” এই কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করলে কোনো মানুষের পক্ষে সাম্প্রদায়িক হওয়া সম্ভব নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষকে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। মানুষকে ঐক্যে বিশ্বাস করতে শেখায়। নিজের ধর্মের প্রতি যেমন বিশ্বাস জোরালো করে তেমনি অন্যের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা যাবে না এই বোধও তৈরি করে দেয়। এদেশে প্রবাহমান জীবনসংস্কৃতির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সমৃদ্ধ চেতনা মানুষকে করেছে আরও উন্নত। অতীতে কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনের অপরাজনীতি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস চালালেও সফল হতে পারেনি। বাঙালির আবহমান ঐতিহ্য সেই অপপ্রয়াসকে বারবার ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিতে বিশ্বাসী বাঙালিরা আগামীতেও এধরনের অপপ্রয়াস প্রত্যাখ্যান করবে।
আমাদের জাতি-বর্ণ-ধর্মগত বিভেদকে তুচ্ছ করে সকলের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে শক্তিশালী করতে হবে। সকলের প্রতি সযোগিতা, সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। সকলের ভেতর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। ধর্মান্ধতা ত্যাগ করে মানুষের প্রতি, অন্য ধর্মের প্রতি ও সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
লেখক: প্রবন্ধকার ও মুক্তিযোদ্ধা
বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব ফজল আহমদ
সাবেক কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ড, চট্টগ্রাম।